জল পাবে না পাকিস্তান, ইরাবতীর উপর বিশালাকার বাঁধ নির্মাণ ভারতের


নয়াদিল্লি: স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরও সীমান্ত নিয়ে বিরোধ চলছেই। ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে এবার নয়া মাত্রা যোগ করল জল-বিবাদ। পঞ্জাবে ইরাবতী নদীর উপর বাঁধ গড়ে, পাকিস্তানে জলের জোগান কার্যতই আটকে দিল ভারত। এর ফলে, ইরাবতী নদী থেকে আর পাকিস্তানে জল পৌঁছবে না। (Ravi River Water Flow)

পঞ্জাবে ইরাবতী নদীর উপর শাহপুরকণ্ডী বাঁধ নির্মাণ করেছে ভারত। পঞ্জাব সরকার জানিয়েছে, ওই বাঁধের উচ্চতা ৫৫.৫ মিটার। দুইদিকে ২০৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী পাওয়ারহাউজ বসানো হচ্ছে।  এর ফলে প্রায় ১১৫০ কিউসেক অতিরিক্ত জল রয়ে যাবে ভারতের হাতে, যা এতদিন পাকিস্তানে গিয়ে পৌঁছত। এই অতিরিক্ত জল পঞ্জাব সীমানালগ্ন জম্মু ও কাশ্মীরের কৃষিকার্যে ব্যবহৃত হবে বলে দিল্লি সূত্রে জানা গিয়েছে। (Indus Water Treaty)

দিল্লি সূত্রে জানা গিয়েছে, ইরাবতী থেকে প্রাপ্ত অতিরিক্ত জল উপত্যকার কৃষিকার্যে ব্যবহার করা হবে। কাঠুয়া এবং সাম্বা জেলায় যে ৩২ হাজার হেক্টর জমিতে চাষাবাদ হয়, সেখানে ওই জল কাজে লাগানো হবে। দীর্ঘকালীন বাধা-বিপত্তির পর ওই বাঁধের নির্মাণ এবং সেখানে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির কাজে সম্পূর্ণ হওয়ার পথে।

তবে ভারতের এই সিদ্ধান্তকে ঘিরে দুই দেশের মধ্যে ফের সংঘাত দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন কূটনীতিকরা। কারণ জল নিয়ে এই বিবাদ আজকের নয়। ১৯৪৮ সালের ৪ মে প্রথম সেই নিয়ে ইন্টার-ডমিনিয়ন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যাতে বলা হয়েছিল, বার্ষিক মূল্যের বিনিময়ে পাকিস্তানকে প্রয়োজন অনুযায়ী জলের জোগান দেবে ভারত। কিন্তু সেই চুক্তি বেশি দিন টেকেনি। যে কারণে বিশ্ব ব্যাঙ্কের তদারকিতে ১৯৬০ সালে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে সিন্ধু জলচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

আরও পড়ুন: Alexei Navalny Death:হৃৎপিণ্ডে একটি মোক্ষম ঘুষি, সাবেক KGB-র চেনা কৌশল মেনেই কি ‘খুন’ নাভালনি?

সিন্ধু জলচুক্তি অনুযায়ী,  ইরাবতী, শতদ্রু এবং বিপাশা নদীর জলের উপর ভারতের নিয়ন্ত্রণ কায়েম হয়। অন্য দিকে, সিন্ধু, ঝিলম এবং চন্দ্রভাগা জলের উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম হয় পাকিস্তানের। পাকিস্তান নিয়ন্ত্রণাধীন নদী থেকে জল ব্যবহার করা গেলেও, বিশেষ পরিস্থিতি ছাড়া সেখানে কোনও নির্মাণ বা সংরক্ষণ প্রকল্প ভারত গড়ে তুলতে পারবে না বলে সাফ জানানো হয় চুক্তিতে। যদিও জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণে ছাড়পত্র দেওয়া হয় শর্তসাপেক্ষে। সেশেত্রে প্রকল্পের স্থান, নকশার উপর সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে বলে জানানো হয়। পাকিস্তানকে নিজের মতামত জানানোর অধিকার পায়।

দুই দেশের সম্মতিতেই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল যদিও, কিন্তু চুক্তি নিয়ে কম অনুযোগ ছিল না। ভারতের তরফে অভিযোগ তোলা হয়, চুক্তিতে বিশেষ পরিস্থিতিতে জল সংরক্ষণে ছাড়পত্র দেওয়া হলেও, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার বৈরিতার দরুণ তাতে বাধা সৃষ্টি করে পাকিস্তান। জম্মু ও কাশ্মীরের বিতর্কিত এলাকার উপর দিয়ে প্রবাহিত নদীর জল নিয়েও ঝামেলা বাধে দুই দেশের মধ্যে। চন্দ্রভাগা নদীর উপর সালাল জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, টুলবুল প্রকল্প এবং কিষেণগঙ্গার উপর জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়েও সংঘাত দেখা দেয়।

এ নিয়ে জলনীতি বিশেষজ্ঞ রামস্বামী আর আইয়ার বিশদে লিখেছিলেন। তিনি জানান, সাময়িক ভাবে জল সংরক্ষণের অনুমতি দেয় ওই চুক্তি।  কিন্তু বিশেষ পরিস্থিতি বলে বিশদ কোনও উল্লেখ নেই। অর্থাৎ কারিগরি দিক থেকে ত্রুটি রয়েছে। ভারত যেমন চুক্তির ফাঁক-ফোকর গলে পশ্চিমের নদীগুলির উপর একাধিক প্রকল্প গড়ে তুলতে আগ্রহী, পাকিস্তানও বার বার কারিগরি ত্রুটিগুলির দোহাই দিয়ে তাতে বাধা দিতে এগিয়ে আসে।  

কিষেণগঙ্গা বাঁধ প্রকল্প এবং রাতলে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের ক্ষেত্রেও একই সমস্যা দেখা দেয়। ২০০৭ সালে কিষেণগঙ্গা বাঁধ প্রকল্পের সূচনা করে ভারত। ২০১৬-র মধ্যে সেটির কাজ সম্পূর্ণ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ২০১০ সালে বিষয়টি নিয়ে কোর্ট অফ আরবিট্রেশনের দ্বারস্থ হয় পাকিস্তান। ছয়টি সমস্যার কথা তুলে ধরে আপত্তি জানায় তারা। ২০১৩ সালে ওই প্রকল্পে শর্তসাপেক্ষে ভারতকে ছাড়পত্র দেয় কোর্ট অফ আরবিট্রেশন। জানানো হয়, ভারত নির্মাণকার্য চালালেও, প্রতি সেকেন্ডে পাকিস্তানকে ৯ কিউবিক মিটার জল দিতে হবে। তবে কোনও পক্ষই সেই নিয়ে একমত হয়নি।

একই ভাবে রাতলে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পটি নিয়েও টানাপোড়েন শুরু হয়। দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ প্রকল্পটির সূচনা করেন ২০১৩ সালের জুন মাসে। সেই নিয়েও আপত্তি জানায় পাকিস্তান। সে বছর সেপ্টেম্বরে সিন্ধু কমিশনের বৈঠকও বসে। সিন্ধু জলচুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগ তোলে। জানায়, ওই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে তাদের ভাগের জল কমে যাবে। ভারত যদিও আশ্বাস দেয়, সিন্ধু জলচুক্তি মেনেই নির্দিষ্ট পরিমাণ জল ব্যবহার করা হবে। কিন্তু মন গলেনি পাকিস্তানের।

এর পর ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে উরিতে ভারতের সেনা ছাউনিতে সন্ত্রাসী হামলার পর ওই বৈঠক থেকে সরে আসে ভারত। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, “জল এবং রক্ত একসঙ্গে বইতে পারে না।” পাকিস্তান সন্ত্রাসে মদত জোগানো বন্ধ না করলে কোনও বৈঠক হবে না বলে জানায় দিল্লি। ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে পাকিস্তানকে নোটিস ধরায় ভারত। সিন্ধু জলচুক্তিতে সংশোধনের প্রয়োজন কয়েছে বলে জানায়। সিন্ধু জলচুক্তি কমিটির মাধ্যমেই ওই নোটিস ধরানো হয়। কিন্তু পাকিস্তান আলোচনায় বসতে রাজি হয়নি। সেই আবহেই ইরাবতীর উপর বাঁধ তৈরি করল ভারত। তাই জল নিয়ে বিবাদ বহুদূর গড়াতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

যদিও সিন্ধু জলচুক্তি ভেঙে বেরিয়ে আসার পক্ষপাতী নয় ভারত-পাকিস্তান, কোনও দেশই। কারণ সামরিক দিক থেকেও এই চুক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জলের জোগান বন্ধ হলে পাকিস্তান সমস্যায় পড়বেই। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতের ভাবমূর্তি ধাক্কা খাবে। আবার পাকিস্তানের হয়ে প্রতিশোধ নিতে, তাদের বন্ধু দেশ চিন সিন্ধু এবং ব্রহ্মপুত্রের জল আটকে দিতে পারে যেমন, কারণ চিন থেকেই উৎপত্তি ব্রহ্মপুত্রের, যা স্থানীয় ভাষায় সাংপো নামে পরিচিত। ব্রহ্মপুত্রের উপর একাধিক জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের নির্মাণে উদ্যোগী হয়েছে, যা ভারতের জন্য সুখকর নয়। তাই নদীর উপর নিয়ন্ত্রণ থাকলে শত্রুপক্ষকে ঠেকানো সম্ভব বলে মত আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের।   

আরও দেখুন



Source link

https://sluicebigheartedpeevish.com/u4j5ka2p?key=f9b1fb0aab078545b23fc443bdb5baad

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

%d bloggers like this: